Search This Blog

উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান

ধর্ম একটি মৌলিক ও সার্বজনীন মানবীয় প্রতিষ্ঠান। ধর্মের অস্তিত্ত্ব নেই অথবা ছিল না এমন কোন মানব সমাজের কথা সমাজবিজ্ঞানী বা নৃবিজ্ঞানীদের জানা নেই। নৃবিজ্ঞানী মার্ডক বলেন সব সমাজেই কোন না কোন পন্থায় অতি প্রাকৃত শক্তিকে তোষামদ করে এবং নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে। প্রতিটি সমাজেই জন্ম, আত্মা, মৃত্যু, মৃতের অন্তোষ্টিক্রিয়া,মৃত্যু পরবর্তী জীবন ইত্যাদিকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য আচার-বিশ্বাস ধ্যান ধারনা। এসব বিশ্বাস এবং তৎ সংশ্লিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানকেই ধর্ম নামে আখ্যা দেওয়া হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে টেইলরসহ কতিপয় নৃবিজ্ঞানী ধর্মের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু, আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা ধর্মের সংজ্ঞা ও উৎপত্তির বিষয়ে তেমন আগ্রহ না দেখিয়ে ধর্মের সামাজিক ভূমিকা বা কাজের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ধর্ম কি কি কাজ করার মাধ্যমে সমাজে তার অস্তিত্ত্ব বজায় রেখেছে সেটাই হচ্ছে আধুনিক নৃবিজ্ঞানীদের চিন্তা ও গবেষণার বিষয়।
“ক্রিটিক অফ হেগেল’স ফিলসফি অফ রাইট” এর (১৯৪৩) ভূমিকায় মার্ক্স লেখেন প্রয়োজন হচ্ছে সেই মনুষ্যাবস্থা এবং সম্পর্কাদির বিশ্লেষণ যেটি এটিকে মানবজাতির জন্য অপরিহার্য করে তোলে। ধর্ম হচ্ছে মানুষের খুঁতপূর্ণ আত্ম-উপলব্ধির একটি বহিঃপ্রকাশ, এই মানুষটি বিমূর্ত ব্যক্তিরূপী মানুষ নয় বরং সামাজিক মানুষ, অর্থাৎ যূথবদ্ধ অর্থে মানব সমষ্টি। রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী- নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ, সমাজ ও সংস্কৃতি, অধ্যায় নয়, পৃষ্ঠা-২৭৫।
“অন দ্যা জিউইশ কোয়েসচেন-এ (১৮৪৪) মাক্স তার বিশ্বাস পূর্ণব্যাক্ত করেন যে, উৎপাদন ব্যবস্থার অযৌক্তিকতাগুলোকে অচ্ছাদিত করা বাদে ধর্মের ধূম্রজালের আর কোন ক্রিয়াকর্ম নেই। মার্ক্স যদিও ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন তা সত্ত্বেও তিনি মনে করতেন ধর্মীয় বিশ্বাস
বাস্তবিক যন্ত্রনার প্রতি একটি প্রতিরোধ ইঙ্গিত করে এবং এটি আরো ভাল জগতের প্রতি ইতিবাচক অনুপ্রেরণা যোগায়। রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী- নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ- সমাজ ও সংস্কৃতি, অধ্যায় নয়, পৃষ্ঠা-২৭৪।
‘ডুর্খেইম বলেন, ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে এক অর্থে খোদ সমাজের রূপক। ধর্মের মত সর্বব্যপৃত একটি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি ‘বভ্রান্তি’ কিংবা ‘মায়া’ হতে পারে, তিনি এটি মানতে রাজি ছিলেন না।’ ডুর্খেইমের মত দার্শনিক উইলিয়াম জেমসও মনে করে যে, সবচাইতে বর্বর এবং উদ্ভট ধর্মীয় আচার কিংবা পুরানের ভিত্তি কোন না কোন মনুষ্য চাহিদা, কিংবা জীবনের কোন একটি দিক। এটি ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক হতে পারে। রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধরী-নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ, সমাজ ও সংস্কৃতি, অধ্যায় নয়, পৃষ্ঠা-২৭৫-২৭৬।
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হচ্ছে সামাজিক দলের কর্তৃত্ত্বব্যক্ত করনের সর্বোপযুক্ত সময়। ডুর্খেইম বলেন, সামাজিক চাপ ব্যক্ত করা হয় আধ্যাত্মিক উপায়ে। এটি সম্ভব কারন আচারানুষ্ঠানের সময়, যখন বহু মানুষ উপস্থিত থাকেন, একটি উচ্চকিত অনুভূতিমূলক অবস্থা তৈরি হয়, যেটি তার ভাষায়, বিকার
(delirium) কিংবা সমষ্টিগত ফেনানো (collective effervescence)|
উপরন্তু, আচার অনুষ্ঠান কেবলমাত্র বিশ্বাসীদের মধ্যকার এবং ঈশ্বরের প্রতি বন্ধনকে শক্তিশালী করে না, এটি সমাজের সদস্যদের সাথে দলের বন্ধনাক ও শক্তিশালী করে। আচার অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে দল নিজের অস্তিত্বের ব্যাপারে সচেতন হয়। ডুর্খেইম আরো বলেন, দলের মানুষজন সমষ্টিগত বোধ ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে একত্রিত বোধ করেন, তারা সম্মিলিত হন এবং এটি তাদেরকে তাদের নৈতিক ঐক্যের ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। গূঢ় অর্থে, ডুর্খেইম ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানকে দলেরর অনুভূতি এবং সংহতি প্রকাশের ও সেটিকে পুনরায় পাকাপোক্ত করনের একটি প্রধান বন্দোবস্ত হিসেবে দেখান।রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধরী-নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ, সমাজ ও সংস্কৃতি, অধ্যায় নয়, পৃষ্ঠা-২৭৫-২৭৬।
সুতরাং ধর্ম বুঝতে গেলে কোন সমাজের হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা অর্থাৎ সেই সমাজবদ্ধ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ফুটে ওঠবে। অন্য দিকে ধর্ম উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জড়িত। ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় উৎপাদন কৌশলের ভিন্নতার কারণে। যেমন: মনসা প্রধানত: সাপের দেবী কিন্তু কৃষি প্রধান এলাকায় কৃষকেরা পূজা করে কৃষির দেবী হিসেবে। এছাড়াও এখনো গ্র্যাম্য কৃষি প্রধান অর্থনীতিতে বৃষ্টির জন্য মেঘের কাছে কান্নাকাটি, প্রার্থনা বা পূজা করতে দেখা যায়; কিন্তু, শিল্প প্রধান নগরায়ন এলাকায় বৃষ্টির জন্য মেঘের কাছে প্রার্থনা করতে দেখা যায় না। এভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার কারনে ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পরিবর্তিত হয়।
ধর্মের রয়েছে নানা রূপ, রয়েছে উঃপত্তিগত ভিন্নতা। ঠিক তেমিন এর পরিবর্তনও ঘটে থাকে। ধর্ম কোন ধ্র“ব বিষয় নয়। সামাজিক মানুষের নানাবিধ অর্জনের সাথে সাথে ধর্মের পরিধি কিংবা আনুষ্ঠানিকতার সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন প্রভৃতি সাধিত হচ্ছে। যদি বিবর্তনবাদী নৃবিজ্ঞানীদের কথা বলি তাহলে ধর্ম নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে এ.বি টাইলরের প্রিমিটিড কালচার (১৯৭১) অন্যতম। তিনি এখানে দেখিয়েছেন কিভাবে ধর্ম অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস থেকে সর্ব প্রান বাদের সৃষ্টি। সকল বিবর্তনবাদীদের মূল কথা কোন সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ নিু অবস্থা থেকে উচ্চ অবস্থায় গমন করে। অন্যদিকে আধুনিক বিবর্তনবাদীদের সাথে একমত পোষণ করে বলতে চাই ধর্মের এইরূপ একমুখী বিবর্তনের পাশাপাশি চর্তুমুখী পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমন: ধর্মের নানাবিধ আচার-আচারণ সামাজিক জটিলতার কারণে লোপ পায়। পুজিবাদী অর্থনীতি এবং শিল্প বিপ্লবের ফলে ধর্মের আবেদন কমে যেতে শুরু করেছে। “প্রগতির ধারা যেভাবে ধর্মীয় ভাবনা ও অনুশীলনকে স্থানচ্যুত করেছে এবং যৌক্তিকীকরণ যেভাবে সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করছে এই পরিবর্তন সমূহকে, মার্ক্স, ডুর্খেইম ও ওয়েবার তিনজনাই অতিগুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।”রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধরী-নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ, সমাজ ও সংস্কৃতি, অধ্যায় নয়, পৃষ্ঠা-২৭৪।
আমাদের সমাজেও এই পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। আধুনিকীকরণ যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা প্রাকৃতিক কারণে নানাবিধ ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান আজ বিলুপ্তির পথে। ১০ই মহররমের সেই মাতম কিংবা তাজিয়া সম্মলিত শোক মিছিল পুরান ঢাকায় ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। তদ্রুপ প্রাকৃতিক কারণে দক্ষিণ বঙ্গে বাৎসরিক যে ঘোড় দৌড় অনুষ্ঠিত হতো। সেটিও প্রায় জাদুঘরের দিকে ধাবমান।
ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠান আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে হতে কিংবা তার জৌলুস কমতে কমতে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি থেকে। এর জন্য নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। ধর্মের প্রতি পক্ষ হিসেবে সবাই বিজ্ঞানকে দায়ী করলেও আধুনিকায়ন, নগরায়ন, শিল্পায়ন, জীবন যাত্রার মানের উন্নতি, সামাজিক জীবনের জটিলতা ও সমান দায়ী। কিন্তু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তনের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানে উৎপাদন ব্যবস্থা। সেটি পরোক্ষভাবে কার্ল মার্ক্সের নানাবিধ কাজের মাধ্যমে উঠে আসে। ধর্মের উৎপত্তির সাথে উৎপাদন ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যখন সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা সৃষ্টি হল সাথে সাথে সৃষ্টি হল পান্ডা, পুরোহিত নামক নতুন একটা শ্রেণী। পুরোহিতরা ধর্মীয় আচার-আচরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওয়েবার বলেন, ধর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুরোহিতদের অস্তিত্ত্ব। এরা ধর্মীয় বিশ্বাসের যৌক্তিকীকরনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে। যখন সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে দুটি শ্রেণী সৃষ্টি হল মেহনতকারী ও ভোতাকারী। এই মেহনকারী মানুষের জন্য সৃষ্টি হল ধর্ম। “মার্ক্সের ভাষায় ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িত জনগনের আফিম  কিংবা যন্ত্রনা নিবারক।” আফিম খেলে বাঘ বাঘ ঝিমিয়ে থাকবে, মাথা তুলতে পারবে না, তাই কোন দিন সে খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারে এমন দুঃচিন্তার কারণ থাকবে না। বাঘের বেলায় যেরকম ব্যবস্থা মেহনকারী মানুষদের বেলাতেও ঘানিকটা সেই ধরনে ব্যবস্থা গড়ে উঠল। এই ব্যবস্থাটার নাম ধর্ম।”- দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, যে গল্পের শেষ নেই, পৃষ্টা নং-৫৮। যশোরের ভবদহ  এলাকায় ৬-৭ বছরে আগে জলাবদ্ধতা শুরু হয়। যা তাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষি অর্থনীতিকে বিপর্যস্থ করে। সেখানে তাদের নতুন ধরনের উৎপাদন কৌশল গ্রহণ করতে হযত তাদের অস্তিত্ত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা তাদের ধর্মীয় আচার-আচরনে প্রভাব ফেলছে।

No comments:

Post a Comment